শাগায়েঘ ঘুমিয়ে আছে। ভোরের প্রথম কমলা আলো অর্ধস্বচ্ছ পর্দা ভেদ করে ওর অনাবৃত দেহকে আভাময় করে তুলেছে। হাল্কা ঢেউ খেলানো ঘন-কার্বন চুল ওর ঘাড় আর কপালময় লুটানো। সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আর একটা গানের কলি মাথার ভেতর তরঙ্গ তুলছে, ঘন কুন্তল-ভার ললাটে নত, ক্লান্ত তড়িৎ-বধূ তন্দ্রাগতা। আমার দৃষ্টির গন্ডোলা ওর শরীরের স্রোতস্বিনী বেঁয়ে মোহনা অবধি বয়ে চললো। শঙ্খের মত শুভ্র ওর বক্ষ যুগল যেন মৃন্ময় দেহে প্রস্ফুটিত জোড়া পদ্ম। তারও দক্ষিনে নাভিনিম্ন থেকে ওর মেদহীন পা দুটো মহা অনন্তে নেমে গেছে। শাগায়েঘের ভ্রূপল্লব হঠাৎ তির তির করে সামান্য কেঁপে উঠলো, হয়তো স্বপ্নের ঘোর। ওর পাতলা ঠোঁটে হাল্কা হাসির রেখা। আমি শাগায়েঘের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললাম, ‘দুস্তেত দরাম’, মানে ভালোবাসি তোমায়।
ঘুমিয়ে আছে বলে শাগায়েঘের চোখের নীলাভধূসর দীপ্তি থেকে বঞ্চিত হলাম। ওকে জিগেস করেছিলাম এমন হৃদয়হরণ চোখের আলো সে কোথা থেকে পেলো। ও লজ্জিত কণ্ঠে বলেছিল, ইরানের উত্তরে একটা শহর আছে নাম তাব্রিজ। সেই শহরের সীমান্তে আরেক দেশ আজারবাইজান। তাব্রিজের অনেকেরই ওর মত ও আজারবাইজানি আর পার্সিয়ানদের মনোজ্ঞ মিশ্রন।
নারী পুরুষের ভালোবাসা বেশীরভাগ সময় একটা বিসমতা তৈরি করে। শরীর আর মনের। কখনো কখনো ভালোবাসার আশি ভাগ শরীর, বিশ ভাগ মন আবার কখনো বিশ ভাগ শরীর, আশি ভাগ মন। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে আমরা শরীরের জন্য একজনে প্রলুব্ধ হই, মনের জন্য অন্যজনে। মন কিম্বা শরীরের অর্ধতৃপ্তি নিয়ে আমাদের অপূর্ণাঙ্গ যুগল জীবন অনন্তের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু শাগায়েঘের সঙ্গে আমার মিলন মুহূর্তগুলো ছিল অতিলৌকিক। আতসী কাঁচের ভেতর দিয়ে প্রতিসৃত সূর্য রশ্মি যেমন একটি বিন্দুতে ঘনীভূত হয়ে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে তেমনি আমাদের শরীর ছিল আতসী কাঁচ, মন ছিল সূর্যের ছটা আর আমাদের আনন্দ-সংরাগগুলো ছিল দাউ দাউ অগ্নি-উৎসব।
অনেকেই বলে প্রথম দর্শনে প্রেম একটা চটুল আর অবান্তর মিথ। কিন্তু সেই অবান্তর রসায়নটাই আমাদের মনোকাঠামো ওলটপালট করে দিয়েছিল ইউ সি এলের কেমিস্ট্রি ল্যাবে। দুজনেরই প্রথমে দৃষ্টি অপরের হৃদয়ে গিয়ে হেনেছিল। শাগায়েঘের সঙ্গে পরিচয়ের পর জেনেছি ইরানীদের জাত্যাভিমান ভীষণ প্রবল। ওদের সঙ্গে আরবদের মিলিয়ে ফেললে কিম্বা পারস্য উপসাগরকে আরব উপসাগর বললে ওরা খুব অপমানবোধ করে। সব জাতির একটা আত্মা থেকে, অনেকটা প্রাণ ভোমরার মত। শাগায়েঘ চাইতো আমি পারস্যের আত্মাকে স্পর্শ করি। এক ঈদুল ফিতরের দিন জানতে পারলাম ঈদ না, ওদের সবচেয়ে বড় উৎসব নওরুজ। নওরুজ হলো বসন্তের আরম্ভ এবং নূতন বছরের প্রথম দিন। পার্সিয়ানদের পূর্বপুরুষ অগ্নি-উপাসক জুরাস্ত্রিয়ান। ওরাই এই উৎসবের সূচনা করেছিল। নওরুজের আগে বুধবার শবে কাহার। ওই দিন ইরানের পথঘাট রূপালী তারাবাতি আর লালাভ আগুনের স্ফুলিঙ্গে আলোকিত হয়ে ওঠে। পথে পথে বিছানো থাকে আগুনের কুন্ড। সেগুলো লাফিয়ে পার হলে আত্মশুদ্ধি ঘটে। নওরুজের আগে আগে ওরা বাড়িঘর আবর্জনারহিত করে, সাতটা রূপকের সূত্র ধরে সাত রকম ব্যঞ্জন সাজায়। আমি ওকে বলেছিলাম আমাদের একটা গান আছে, মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক। ও পুলকিত হয়ে বলেছিল এ তো নওরুজকে নিয়েই লেখা।
শাগায়েঘের হাত ধরেই আমি প্রবেশ করেছিলাম আব্বাস কিওরাস্তামির আর আশগার ফারহাদির চলচিত্রের জগতে। ও-ই আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় দারিউশের বেদনাময় সঙ্গীতের সঙ্গে। ও বলেছিল এইই হলো পারস্যের আত্মা, বিরহ, বিচ্ছেদ আর মেলানকোলিয়ায় টইটম্বুর। সেই জীবনপাত্র উপচে পড়া মেলানকোলিয়া মাঝে মধ্যেই শাগায়েঘকে ছুঁয়ে যেত। প্রসঙ্গান্তরে জেনেছি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ও একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী ছিল। যত না লেখাপড়ার জন্য তারচেয়েও বেশী রাজনৈতিক কারনেই ও দেশ ছেড়ে চলে আসে। এই খোদ লন্ডনে বসেও শাগায়েঘ ইরানি ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করত, প্ল্যাকার্ড হাতে প্রায়ই ইরানি এমব্যাসির সামনে বিক্ষোভে যোগ দিত। দেশের ভালোমন্দ নিয়ে ওর উত্তেজনা আর অস্থিরতা দেখে বুঝতাম শাগায়েঘের জীবনের মূল প্রবাহের মাঝে আমি বোধ হয় একটা অতি ব্যক্তিগত রঙিন চোরা স্রোত।
আমার ভাবনাই সত্য হয়েছিল। এক বিকেলে ওর বাড়িতে এসে দেখি দরোজায় তালা ঝুলছে। আমার জন্যে একটা চিরকুট রেখে গেছে। অরিত্র, সুখে থাকো, আনন্দে থাকো। জেনে রেখো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় তোমার সঙ্গেই অতিক্রান্ত হয়েছে। আজ সময়ের অমোঘ প্রয়োজনে নিজেকে সমর্পণ করলাম, কোথায় কেন তা জেনে তোমার কাজ নেই। রুমির ভাষায় বলব, ভালো আর মন্দের অতীত এক ধূসর জগত আছে। একদিন সেখানে আমাদের আবার দেখা হবে।
বুঝলাম মানুষের জীবনে প্রবল আনন্দের মুহূর্তগুলো কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হয় না, এ জন্যই এরা কাল নয়, কেবলই মুহূর্ত।
লন্ডনে ওয়াটারলু ব্রিজের খুব কাছে গ্যারিক স্টিটে একটা পার্সিয়ান রেস্টুরেন্ট আছে। নাম কাভেহ। ইরান থেকে আনা নীল পাথর দিয়ে রেস্তুরেন্টের মেঝেতে মোজাইকের নক্সা আঁকা। দেয়ালে কাঠের লোকজ কারুকাজ আর বড় একটা এলসিডি টিভি। শাগায়েঘ আর আমি প্রায় বিকেলে এই রেস্টুরেন্টে আসতাম, কোনার টেবিলের নিরিবিলিতে বসতাম।
শাগায়েঘ নেই, তারপরও আমি এখানে এসে সেই বিজন কোনেই একলা বসি। এক কাপ কফির পেয়ালা হাতে টেলিভিশনের দিকে অনর্থক তাকিয়ে থাকি। মনের গভীরে কোথায় একটা ক্ষীণ আশা বয়ে বেড়াই একদিন এখানেই শাগায়েঘের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে। রেস্টুরেন্টে কোন ইরানি যুগল এলেই আড় চোখে তাকাই মেয়েটি শাগায়েঘ কিনা। এই নজরদারির জন্য পরক্ষণেই লজ্জিত হই। শাগায়েঘ এমন লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু করবার মানুষ না, ও সেই পতংগ যে শুধু মহাকাব্যিক জাগরণের বহ্নুৎসবেই ঝাঁপ দেবে।
১৯৮৮ সালের ২১শে মার্চ ছিল নওরুজ। মন বলছিল আজ শাগায়েঘের দেখা পাব। তখন পড়ন্ত বিকেল। আমি কাভেহ রেস্টুরেন্টের সেই কোনার টেবিলে এক কাপ কফি হাতে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছি।
শেষ পর্যন্ত আমার স্বপ্ন পূরণ হলো।
ইরান ইরাক যুদ্ধ তখন বন্ধ হওয়ার পথে। খোমেনি আবার ঘরের শত্রুর দিকে নজর দিয়েছে। নূতন ফতোয়ায় নির্দেশ হলো বিরোধীদের যেন নির্মমভাবে নির্মূল করা হয়। কিন্তু মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী আর আমজনতা রাজপথে। ওরা কি তখনো জানতো যে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের ভিতর স্বৈরতন্ত্রের হাত রঞ্জিত হব ত্রিশ হাজার মুক্তিকামী নাগরিকের রক্তে?
বিবিসির খবরে তেহরানের রাস্তায় ছাত্র আন্দোলনের দৃশ্য দেখাচ্ছিল। চারিদিকে গুলি আর টিয়ার গ্যাসের শব্দ। রিভলুশনারি গার্ডরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে দল বেঁধে ধেয়ে আসছে আর ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়ুচ্ছে। গ্র্যান্ড বাজারের কাছে খৈয়ম স্ট্রিটে মিছিলের অগ্রভাগে কেউ একজন ব্যাটনের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। বিবিসির ক্যামেরা ক্লোজ আপ হলো। মুখটা স্পষ্ট দেখলাম, শাগায়েঘ। ও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। দু’তিন জন ধরাধরি করে ওকে একদিকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।
শাগায়েঘকে এভাবে পাবো ভাবিনি। ওর জন্য অদ্ভুত গর্ব অনুভব করলাম, কষ্টও পেলাম। পাশাপাশি দূরত্ব আর অজ্ঞতাজনিত কারনে ওর কাছাকাছি থাকার অপারগতায় আমার মনটা শামুকের মত গুটিয়ে গেলো।
লন্ডনে শাগায়েঘের দু একজন রাজনৈতিক বন্ধুর সাথে আমার সামান্য পরিচয় ঘটেছিল। সেই সূত্র ধরে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। জানালাম আমাকে তেহরান যেতে হবে, শাগায়েঘকে খুঁজে পেতে হবে। ওরা বললো সময় খুব খারাপ, এখন যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আমি জানালাম আমার নিয়তি শাগায়েঘের নিয়তির সঙ্গে নির্ধারিত হয়ে গেছে।
ওদের ভাষ্যমতে এই মুহূর্তে মোটামুটি ঝুঁকিহীন উপায় হলো কোন একাডেমিক কনফারেন্স খুঁজে সেখানে যোগ দেয়া। আমার ভাগ্য ভালো ছিল। একটা কেমিস্ট্রি কনফারেন্স পেয়ে গেলাম ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটিতে। নিবন্ধনের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ওদেরকে আলাদা করে ইমেইল করে রেজিস্ট্রেশন করলাম। ভিসা পেতে লেগে গেলো আরও সাত দিন।
শাগায়েঘের বন্ধুরা আমার প্রেম ও একাগ্রতায় সামান্য দ্রবীভুত হলো। আগ বাড়িয়ে জানালো, শাগায়েঘ এম কে ও বলে একটা ইসলামিক সমাজতান্ত্রিক গ্রুপের সাথে জড়িত। একটা ফোন নম্বর দিলো, তেহরানে পৌঁছে যেন যোগাযোগ করি।
এপিল মাসের পাঁচ তারিখ আমি তেহরানের বুকে পা রাখলাম। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে পৌঁছেই ওই নম্বরটায় ফোন করলাম। ওরা লন্ডন থেকে জেনে গিয়েছিল আমি আসব। বললো রাত আটটায় যেন আজাদি টাওয়ারের নীচে অপেক্ষায় থাকি। যায়গাটা পর্যটন এলাকা, সন্দেহের উদ্রেক ঘটার সম্ভাবনা কম।
মাঝের সময়গুলো কীভাবে কেটে গেলো বলতে পারব না। ওদের কথা মত গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে দুবার টাক্সি বদলে আটটা বাজার দশ মিনিট আগেই আজাদি টাওয়ার থেকে সামান্য দূরে একটা ফালাফেল রেস্টুরেন্টের কাছে নেমে পড়লাম। সেখান থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে ইস্ফাহানের মার্বেল পাথর মন্ডিত আজাদি স্মৃতিস্তম্ভের অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী অবলোকন করছিলাম। এর স্থপতি হোসেইন আমানাত নাকি বাহাই ধর্মের অনুসারী ছিলেন। খোমেনি ক্ষমতায় আসার পর হোসেইনকে দেশ থেকে বিদেয় করে দেয়া হয়। ভাবলাম, মেরে যে ফেলেনি তাই ঢের।
ঠিক আটটায় একটা কালো ভ্যান এসে আজাদি স্কয়ারের থামলো। ভ্যান থেকে কালচে সবুজ জামা পরা একজন নেমে এদিকেই এগিয়ে এলো। শুনেছি খোমেনির রিভলুশানারি গার্ড এরকম পোশাকে পরে। কিন্তু এখন কিছুই করার নেউ। দৌড়ুলে নিশ্চিত গুলি চালিয়ে দেবে।
আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। লোকটা কাছে এসে বললো, গাড়িতে গিয়ে উঠুন। আমি চুপচাপ হেঁটে ভ্যানের পেছনে চড়ে বসলাম। ভ্যানের স্লাইডিঙ দরজা ঝুপ করে বন্ধ হয়ে গেলো। কে যেন কালো কাপড় দিয়ে আমার মুখ ঢেকে দিলো। ইঞ্জিন চালুর শব্দে বুঝলাম গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে।
কেউ কিছুই বলছে না। এরা কারা না জেনে আমিও মুখ খুলছি না। ভ্যানটা বোধহয় এক সময় শহরের কেন্দ্রে চলে এলো। কারন অসংখ্য গাড়ির হর্ন, মানুষের চিৎকার চ্যাচামেচির প্রবল আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। তার ওপরে নাকে এসে লাগছে পেট্রোল আর ডিজেলের ঝাঁঝালো পোড়া গন্ধ।
আধ ঘন্টা এভাবে চলার পর ধীরে ধীরে জনকোলাহল ক্ষীণ হয়ে এলো। এখন শুধু শুনতে পাচ্ছি এবড়ো থেবড়ো পথে গাড়ির টায়ারের উত্থানপতন আর ইঞ্জিনের পিস্টনের শব্দ। ভ্যানটা বোধ হয় একবার অভিকর্ষের অভিমুখে, আরেকবার বিপরীতে যাচ্ছে। আমরা কি তাহলে কোন পাহাড়ি রাস্তায়?
এভাবে প্রায় আরো দু’ঘন্টার চড়াইউৎরাই পেরিয়ে গাড়ি হঠাৎ থামল। ভ্যান থেকে নামিয়ে ওরা আমাকে হাঁটিয়ে কোথাও নিয়ে এলো। তারপর কালো কাপড়ের ঢাকা মুখ থেকে সরিয়ে দিলো। নিজেকে একটা ছোট কুঠুরির ভেতর আবিষ্কার করলাম।
পাথরেরে দেয়াল আরে কাঠের কড়িবর্গার উপর টিনের চালা। একটা দেয়ালে ছোট একটা জানালা, কিন্তু এত ওপরে যে চোখ যায় না। ঘরের সঙ্গে একটা লাগোয়া টয়লেট, টয়লেটের কোন জানালা নেই, এক কোনায় একটা বালতি আর মগ। টেবিলের উপর এক গ্লাস পানি রেখে ওরা দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো।
আমি ঢোক ঢোক করে পানি গিললাম। তারপর প্রচণ্ড ক্লান্তিতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় নেতিয়ে পড়লাম। ঘুমের ভেতর দেখলাম কোথাও ভীষণ গোলাগুলি হচ্ছে, মানুষ দৌড়ুচ্ছে, কেউ কেউ পাখির মত গুলি খেয়ে টুপ টাপ মাটিতে ঝরে পড়ছে। এক যায়গায় অনেকগুলো গাড়ির টায়ার আগুনে পুড়ছে, তার কালো ধোঁয়ায় বাতাস সয়লাব। হঠাৎ একটা বাড়ির জানালা থেকে কে চিৎকার করে বললো, অরিত্র, ভেতরে আসো, ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। আমি তাকিয়ে দেখলামা শাগায়েঘ। ও দৌড়ে নীচে এলো দরজা খোলার জন্য। কিন্তু চাবিয়ে ঘুরিয়ে কোনভাবে লোহার দরজাটা খোলা যাচ্ছে না। ওর হাত থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ চাবির গোছা কংক্রিট টাইলসে পড়ে ঝম ঝম শব্দ করে চাবিগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়েছিটিয়ে গেলো আর আমি তীব্র আতংকে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠলাম। দেখলাম কুঠুরির দরজা খুলে কালকের লোকটা ভেতরে ঢুকেছে। পেছনে আরও দুজন। ভাবলাম, মারতে চাইলে ওরা গতরাতেই মেরে ফেলত। লম্বা লোকটা ভাঙ্গা ইংরেজিতে জিগেস করল,
‘ঘুম হয়েছে?’
‘জি’
‘হাত মুখ ধুয়ে নিন তারপর আমরা বেরুবো’
আমার ভয় তখনো পুরোপুরি কাটেনি। এখনো নিশ্চিত না এরা গোয়েন্দার লোক নাকি শাগায়েঘের। আমি হাত মুখ ধুয়ে একটা অস্বস্তি নিয়ে ওদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম।
চারিদিকে তাকিয়ে বুঝলাম আমরা কোন পার্বত্য উপত্যকায়। সবুজ মখমলে ঢাকা পাহাড়, তুষারে আবৃত তাদের শৃঙ্গ, হঠাৎ ধন্ধ লাগবে এটা ইরান নাকি সুইজারল্যান্ড। লম্বা লোকটি জানালো ওর নাম আব্বাস। আব্বাস বললো, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে শাগায়েঘের কাছে আনার জন্যই এতো সতর্কতা অবম্বন। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আমরা যে যায়গা দিয়ে হাঁটছি সেখান থেকে আরও নীচে নেমে গেছে সবুজ ঘাসের উপত্যকা । ওপর থেকে দেখতে পাচ্ছি অনেকগুলো বাড়ির লাল, নীল, সাদা রঙের টালির ছাদ। ওরকম একটা বাড়িতে বসেই কি শাগায়েঘ সুস্থ হয়ে উঠছে? ওর প্রতিরোধ বাহিনীকে একত্র করে নূতন পরিকল্পনা আঁটছে? আমি জানি একেকটা সময় আসে সমস্ত কিছু ওলট পালট করবার, সেই ভাঙচুর সময়ের লাগাম ধরতে না পারলে ইতিহাস নূতন করে লেখা অসম্ভব। তাপরও আমার ভেতর চাপা একটা অভিমান কাজ করছে। ও কেন আমাকে বললো না? ও কে ভেবেছিল? আমি ওকে আটকে দিতাম?
নীচে নামতে নামতে আব্বাস ডান দিকের একটা সমতলে মোড় নিলো। ওদের পেছন পেছন আমিও একটা নার্সারি নাকি পুষ্প উদ্যানের ভেতর প্রবেশ করলাম।
পুরো উদ্যান জুড়ে দু’তিন রকমের গোলাপ, মরিয়ম, টিউলিপ আর ডেইজি। রঙের বাহারে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো, মনের ভার অনেকটা লঘু হয়ে এলো।
আমরা অজস্র ফুলের সৌরভ আর সিগ্ধতা ইন্দ্রিয়ে মেখে আরও সামনে এগুলাম। একটু দূরে অসংখ্য রক্তলাল পপিফুল রাতের আকাশে অসংখ্য নক্ষত্রের মত ফুটে আছে। আব্বাস সেখানে থেমে বললো,
‘সরকারের চোখ ফাঁকি দেবার জন্য আমরা এই নার্সারিটা নিয়েছি’
আমি বললাম,
‘এটা আপনাদের লোক দেখানো বানিজ্য আর ভেতরে ভেতরে চলে বিদ্রোহের আয়োজন, তাই তো?’
‘অনেকটা তাই’
একটু চুপ করে থেকে আব্বাস বললো,
‘আমরা শিয়ারা খুব বেশী মাজারে দরগা এসবে বিশ্বাস করি। এক তেহরান শহরেই দেখবেন অনেক ইমামের মাজার। সরকারও সেটা খুব ভালো বোঝে’
‘কী ভালো বোঝে?’
‘শুধু আইডিয়া না, একজন ব্যক্তি মানুষ নিজেও অনেক মূল্যবান, অন্তত আমাদের সংস্কৃতিতে’
‘শুধু আপনার কেন, এটা আমাদের দেশেও সত্য। একজন যোগ্য নেতা ছাড়া কি দেশ চলে?’
‘আমি তা বলিনি’
‘তাহলে?’
আব্বাস পপি ফুলগুলো দেখিয়ে বললো,
‘এই ধরুন এখানে আপনার শাগায়েঘ…’
শাগায়েঘ শব্দের অর্থ হলো পপি ফুল। সে আমি জানি। আব্বাসের ঠাট্টা শুনে হেসে বললাম,
‘আমার শাগায়েঘ এর চেয়েও সুন্দর। এখন চলুন যাওয়া যাক’
‘কী বলছেন? কোথায় যাবেন? এই তো আপনার শাগায়েঘ’
‘মানে কী’
‘এখানে যত ফুলের বাগান দেখছেন, সবই কারও না কারও সমাধি। ওই যে হলুদ গোলাপের ঝাড় ওটা মেহদির কবর, ওই যে টিউলিপের সমারোহ ওটা আহমেদের। আর আপনার শাগায়েঘ ঘুমিয়ে আছে এই পপি বাগানে’
আমাকে স্তব্ধতা লক্ষ্য করে আব্বাস বললো,
‘একুশ মার্চের মিছিলে যখন গুলি চলে, শাগায়েঘ ভীষণভাবে আহত হয়। জীবিত অবস্থায় জেলে গেলে ফায়ারিং স্কোয়াড অথবা ফাঁসি, তার আগে কারাগারে গণধর্ষণ। ওকে তেহরানে রাখার ঝুঁকি আমরা নিতে পারিনি, যত দ্রুত সম্ভব এখানে নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের নিজস্ব ডাক্তার আছে কিন্তু এত বেশে রক্তক্ষরণ, থামাতে পারিনি’
আমি নিজের অজান্তেই হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লাম। আব্বাস আমার ঘাড়ে আলতো করে হাত রাখল। তারপর বললো,
‘জানেন তো রিভিলুশনারি গার্ডের লোকজনপ্রয়োজনে মৃতদেহ উধাও করে দেয়। কারো সমাধি ঘিরে যেন কোন স্মৃতিস্তম্ভ বা আন্দোলন দানা বেঁধে না ওঠে। এ কারনেই নার্সারির ব্যবসার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে আমাদের শ্রেষ্ঠ শহীদদের। একদিন যখন আমরা ক্ষমতায় আসব, খুদার ইচ্ছায় তেহরানের বুকে শাগায়েঘের নূতন সমাধি নির্মাণ হবে’
আমার কিছুই বলার ছিল না। শুধু ভাবলাম, আহা শাগায়েঘ, ওর বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ অসংখ্যরক্তলাল পপি হয়ে ও ফুটে আছে এই মুক্ত স্বাধীন পাহাড়ি উপত্যকায়। একদিন হয়তো ন্যায়,অন্যায়, ভালো মন্দ, জীবন মরনের অতীত এক ধূসর উদ্যানে ওকে আমি ফিরে পাব। আপাতত আমার জন্য থাক চির বিরহের দুঃখ ভার।
রক্তাভ পপিফুলগুলোর কাছে মুখ নিয়ে শেষবারের মত ফিস ফিস করে বললাম, দুস্তেত দরাম, আই লাভ ইউ, শাগায়েঘ।